গিবত করাও পাপ, শোনাও পাপ – ইসলামী দৃষ্টিকোণে বিস্তারিত বিশ্লেষণ জেনে নিন।

গিবত করাও পাপ, শোনাও পাপ – ইসলামী দৃষ্টিকোণে  বিস্তারিত বিশ্লেষণ জেনে নিন।

ভূমিকাঃ

ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার জন্য ইসলামে আছে নির্ভুল দিকনির্দেশনা। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো গিবত বা পরনিন্দা থেকে বিরত থাকা। অধিকাংশ মানুষ গিবতের ভয়াবহতা না জেনেই এই গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। শুধু গিবত করাই নয়, গিবত শোনাও ইসলামে সমানভাবে নিষিদ্ধ এবং পাপ হিসেবে চিহ্নিত। এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব—গিবত কি, গিবতের শাস্তি, গিবতের ক্ষতি, কেন গিবত শোনা পাপ এবং কীভাবে এ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।

গিবত করাও পাপ, শোনাও পাপ


গিবত কী? – অর্থ ও ব্যাখ্যাঃ

গিবত (غيبة) শব্দের অর্থ হলো কারো অনুপস্থিতিতে তার এমন কোনো দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা, যা সে শুনলে কষ্ট পাবে বা অপমানিত বোধ করবে—even যদি কথাটি সত্য হয়। যদি মিথ্যা বলা হয়, তবে তা গিবত নয়, বরং বুহতান (অপবাদ), যার গোনাহ আরও ভয়ংকর।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

“তোমরা কি জানো গিবত কী? সাহাবাগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন: গিবত হলো, তুমি তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলো, যা সে অপছন্দ করে। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, যদি সেটা তার মধ্যে থাকে? রাসূল বললেন: যদি তা থাকে, তবে সেটাই গিবত। আর যদি না থাকে, তবে তা বুহতান।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৯)


গিবত করা কেন পাপ? – কুরআন ও হাদিসের আলোকে

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

"হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বিরত থাকো... আর তোমাদের কেউ যেন অপরের গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা ঘৃণা করো!"
(সূরা হুজুরাত: ১২)

এই আয়াতে গিবতকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে— যা ইঙ্গিত করে যে গিবত কতটা ভয়ংকর এবং ঘৃণার কাজ।


গিবত শোনাও কেন পাপ?

অনেকে মনে করে, আমি তো গিবত করিনি, শুধু শুনেছি—তাতে কী আসে যায়? কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণে গিবত শোনাও সমান অপরাধ। কারণ গিবতকারী তখনই উৎসাহ পায়, যখন কেউ তা মনোযোগ দিয়ে শোনে।

হাদীস শরীফে এসেছেঃ

“যে গিবত শুনে এবং কিছু বলে না বা বাধা না দেয়, সে যেন ঐ গোনাহে অংশীদার।”
(মিশকাতুল মাসাবীহ)

যদি কেউ গিবত শোনে এবং চুপ থাকে, হাসে কিংবা সম্মতি দেয়, তবে গোনাহ থেকে রেহাই নেই।


গিবতের ধরণঃ

১। সরাসরি গিবতঃ কাউকে নিয়ে সরাসরি তার অনুপস্থিতিতে খারাপ কথা বলা।
২। ইঙ্গিতে গিবতঃ মুখে কিছু না বললেও চোখের ইশারা, ঠোঁট বাঁকানো বা হাসাহাসির মাধ্যমে গিবত করা।
৩। লিখিত গিবতঃ সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগে কাউকে অপমান করে লেখা।
৪। সতর্কতা বা উপদেশের নামে গিবতঃ অনেকে উপদেশ দেওয়ার নাম করে গিবত করে, যা সঠিক পদ্ধতি নয়।


গিবতের পরিণতি – দুনিয়া ও আখিরাতে

১। দুনিয়ার ক্ষতিঃ

  • সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভেদ তৈরি হয়
  • মানুষের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়
  • আত্মিক শান্তি ও সম্পর্ক হারিয়ে যায়

২। আখিরাতের শাস্তিঃ

  • গিবতকারী নিজের সওয়াব হারাবে
  • গিবতের শিকার ব্যক্তি তার বদলে সওয়াব পাবে
  • মহান আল্লাহর কাছে গিবতকারীর বিচার হবে কঠিন

হাদিসে এসেছেঃ

“মেরাজে আমি এমন কিছু লোক দেখলাম, যাদের নখ ছিল তামার, আর তারা তা দিয়ে নিজেদের মুখ ও বুক চিরছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? বলা হলো, এরা সেই লোক যারা গিবত করত এবং মানুষের সম্মান নষ্ট করত।”
(আবু দাউদ)


গিবত থেকে বাঁচার উপায়ঃ

১। আল্লাহকে ভয় করাঃ সর্বদা মনে রাখুন, আল্লাহ সব দেখছেন ও শুনছেন।
২। নিজেকে সংশোধনঃ অন্যের বদলে নিজের ত্রুটি খুঁজুন।
৩। পরিবেশ পরিবর্তনঃ যদি কোথাও গিবতের আলোচনা হয়, সেখান থেকে উঠে আসুন।
৪। গিবতকারীকে সাবধান করুনঃ সুন্দরভাবে বোঝান যে এটি পাপ।
৫। ইস্তিগফার ও তওবা করুনঃ অতীতে গিবত করে থাকলে ক্ষমা চান ও সংশোধনের চেষ্টা করুন।
৬। দোয়া করুনঃ যার গিবত করেছেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।


গিবত না করে করণীয় কী?

  • ভালো গুণের প্রশংসা করুন
  • বিষয়বস্তু পরিবর্তন করুন
  • বই পড়ুন বা জ্ঞানমূলক আলোচনা করুন
  • চুপ থাকা—এটাও ইবাদত

উপসংহারঃ

ইসলাম আমাদের শুধুমাত্র নামাজ-রোজা শেখায়নি, বরং মানুষের হক আদায় করারও শিক্ষা দিয়েছে। গিবত সেই অভ্যাস যা ধীরে ধীরে সমাজের ভিত নষ্ট করে। তাই আমাদের উচিত—নিজেও গিবত না করা, আর গিবত শুনেও চুপ না থাকা। মনে রাখবেন,
“গিবত করাও পাপ, শোনাও পাপ।”
আসুন, আমরা এই ক্ষতিকর গুনাহ থেকে বাঁচি, নিজেদের চরিত্র উন্নত করি এবং একটি শান্তিময় সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।


Post a Comment

0 Comments